বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেমড সেলে না রাখার আদেশ স্থগিত
![](https://europentv.ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/05/15/untitled_11.png?itok=kgM9JsHh×tamp=1715782935)
অনলাইন ডেক্স : বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের সাজা চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেমড সেলে রাখা অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল, বুধবার সেটি ২৫শে অগাস্ট পর্যন্ত স্থগিত করে দিয়েছে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত।
সোমবার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের বেঞ্চ রায় দিয়েছিলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিচারিক প্রক্রিয়া যেমন- ডেথ রেফারেন্স, আপিল, রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মতো প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের কনডেমড সেলে রাখা যাবে না।
এসব ধাপ নিষ্পত্তির পরই কেবল আসামিকে কনডেমড সেলে রাখা যাবে। অর্থাৎ সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে।
একইসাথে এসব ধাপ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও বলা যাবে না।
হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করলে শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত ওই আদেশ দেন। সেই সঙ্গে আপিল বিভাগের নিয়মিত চেঞ্চে ২৫শে অগাস্ট শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়েছে।
রায়ে যা বলেছিল হাইকোর্ট
আদালতের রায়ে বিশেষ রোগে আক্রান্ত আসামি ছাড়া কনডেমড সেলে থাকা সকল আসামিকে দুই বছরের মধ্যে সাধারণ সেলে স্থানান্তরিত করতে কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেয়া হয়েছে।
হাইকোর্ট রায়ে আরো বলেছে, শারীরিক সমস্যা, যৌন সমস্যা, সংক্রামক রোগের মতো কোনো ব্যাধি থাকলে আসামিকে আলাদা করে রাখা যাবে। তবে, এক্ষেত্রে কারাগারে ওই ব্যক্তির বিষয়ে প্রাথমিক শুনানি করতে হবে। তার বক্তব্য নিয়ে তাকে কনডেমড সেলে রাখা যাবে বলে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের জামিনের শুনানি সাধারণত হয় না। এক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় এসব আসামিরা জামিন আবেদন করলে তা বিবেচনা করার পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাইকোর্ট।
একইসাথে উপযুক্ত ক্ষেত্রে আদালত যাতে জামিন বিবেচনা করে এ বিষয়টিও পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট।
আদালতে রিট শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছিলো, সরকার শিগগিরই নতুন জেলকোড ও নতুন কারা আইন করতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে নতুন আইন ও বিধিতে যেন রায়ে যেসব নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে তা প্রতিফলিত হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট।
রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী শিশির মনির জানান, “মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের বিষয়ে গবেষক, সাংবাদিক বা যে কেউ তথ্য অধিকার আইনে কোনো ধরনের তথ্য জানতে চাইলে তা সরবরাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, সারাদেশের কারা কর্তৃপক্ষকে এ সব তথ্য সরবরাহ করার আদেশ দেয়া হয়েছে।”
মি. মনির বলেন, “হাইকোর্ট রায়ে সাগর-রুনির মামলার কথা উল্লেখ করে বলেছে, প্রায় ১২ বছর ধরে এ মামলার তদন্ত হচ্ছে। এখনও তদন্ত শেষ হয়নি।”
“আদালত বলেছে, আমাদের দেশে ট্রায়াল স্টেজ শেষ হতে ৫-১০ বছর সময় লেগে যায়। এ ধরনের দেরি যেখানে হয়, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের আসামিকে নির্জন সেলে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত যদি বন্দি রাখা হয়। তবে এটি দ্বিগুণ শাস্তি,” জানান মি. মনির
“কারণ নির্জন কক্ষে বাস করা তার সাজা নয়, সাজা মৃত্যুদণ্ড। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এ বিষয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে। ভারতের ওই রায় হাইকোর্টের এ রায় দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে এমনটা উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট।”
একইসাথে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে তথ্য অধিকার আইনে কেউ ডেথ রেফারেন্স বা মৃত্যুদণ্ডাদেশের কোনো তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা কারা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশও দেয়া হয়েছে ।
একইসাথে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ও বার্ষিক বিবরণীতে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা, চূড়ান্তভাবে কত আসামির সাজা কমেছে, কত আসামির মৃত্যুদণ্ড লাঘব হয়েছে এ সংক্রান্ত সকল তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এছাড়াও তথ্য অধিকার আইনে কেউ এসব তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করার আদেশ দিয়েছে আদালত।
মৃত্যুদণ্ডের আদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে কনডেমড সেলে থাকা তিনজন আসামি এ রিট করে। পরের বছর ওই রিটের শুনানি নিয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। সোমবার দুপুরে রুল নিষ্পত্তি করে এ রায় দেয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে এই তিন আসামির করা আপিল এখনো আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাদের আইনজীবী শিশির মনির।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিক্রিয়া
রায়ের পর টর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “এ রায় এখনো চূড়ান্ত নয়। দেশে ইতোপূর্বে এ ধরনের রায় হয়নি। এছাড়া এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এখন পর্যন্ত কোনো রায় নেই। অতএব সরকারের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টে যাবো। কারণ সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত না দেয়া পর্যন্ত কোনো কিছু চূড়ান্ত হয় না।”
“সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট যে আদেশ দেবে তা মানতে বাধ্য হাইকোর্টসহ সব বিচারিক আদালত। আর হাইকোর্টের আদেশ বিচারিক আদালত মানতে বাধ্য। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেয়ার পরই রায় চূড়ান্ত গণ্য হবে। তাই সবার সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে,” বলেন মি. উদ্দিন।
এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জামিন আবেদন বিবেচনা করার যে পর্যবেক্ষণ রায়ে দেয়া হয়েছে এ বিষয়টি উল্লেখ করে মি. উদ্দিন বলেন, “এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে এটা হয়নি। সরকারের সাথে এ বিষয়সহ রায়ে দেয়া সব নির্দেশনার বিষয়ে আলোচনা করবো।”
ভারতে এখনও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কনডেমড সেলে রাখা হয় জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “বিশ্বের অন্যান্য দেশের কী অবস্থা রয়েছে সে বিষয়ে তা আমরা খোঁজ নিবো। কারণ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সময় এসব বিষয় প্রয়োজন হবে।”
‘কনডেমড সেল' এর সাথে অন্যান্য সেলের পার্থক্য কী ?
কারাবিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর একজন বন্দিকে কারাগারে সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখা, দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার বিষয়ে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হলেও আলাদা কক্ষে রাখার বিষয়টি নির্দিষ্ট করে উল্লেখিত নেই।
কোনো কারাগারে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের অন্যান্য অপরাধীদের চেয়ে আলাদা ধরনের কক্ষে রাখা হলেও বাংলাদেশের জেল কোড বা কারাবিধি মোতাবেক সেরকম কোনো আইন নেই বলে বিবিসি বাংলাকে জানান সাবেক কারা উপ মহাপরিদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।
তবে কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণ অপরাধীদের চেয়ে কনডেমড সেলের আসামিদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন বলেও মন্তব্য করেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জেল কোড বা কারাবিধিতে ফাঁসির আসামিদের কনডেমড সেলে রাখার মতো কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকলেও তাদের আলাদা ধরনের কক্ষে রাখা হয়ে থাকে। এটিকে এক ধরনের রেওয়াজ বলা যেতে পারে।”
একটি কনডেম সেলে সাধারণত একজন বা তিনজন বন্দি রাখা হয়ে থাকে।
শামসুল হায়দার বলেন, “সাধারণত ধারণা করা হয় যে দুইজন বন্দি থাকলে গোপনে পালানোর পরিকল্পনা করতে পারে, তবে তিনজন থাকলে পরিকল্পনা আর গোপন থাকে না। ঐ ধারণা থেকেই দুইজন বন্দি একটি কনডেমড সেলে রাখা হয় না।"
কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দির থাকার জন্য ন্যূনতম ৩৬ বর্গফুট (৬ফিট বাই ৬ ফিট) জায়গা বরাদ্দ থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশের জেলগুলোতে কনডেমড সেলের ক্ষেত্রে এই আয়তন কিছুটা বেশি হয়ে থাকে বলে জানান মি. সিদ্দিকী।
একজন বন্দি থাকার কনডেমড সেল সাধারণত ১০ ফুট বাই ৬ ফুট আয়তনের হয়ে থাকলেও বাংলাদেশের অনেক জেলেই সেলের মাপ কিছুটা বড় হয়ে থাকে বলে জানান মি. সিদ্দিকী। আর তিনজন বন্দি যেসব সেলে রাখা হয় সেগুলোর আয়তন আরো বড় হয়ে থাকে।
কনডেমড সেলের ভেতরে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য সাধারণত অন্যান্য সেলের তুলনায় অনেক ছোট আকারের জানালা থাকে। আর এসব সেলে থাকা বন্দিদের দিনে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেলের বাইরে চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়।
শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, “একসময় কনডেমড সেলের বন্দিদের নিজেদের সেলের বাইরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। সেল থেকে বছরের পর বছর বের হননি, এমন উদাহরণও আছে। কিন্তু একটা ছোট ঘরের ভেতরে দীর্ঘ সময় থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, তাই বর্তমানে সব বন্দিদেরই দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বাইরে চলাফেরা করতে দেয়া হয়।”
কনডেমড সেলে থাকা বন্দিরা মাসে একদিন দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পান।
“আগে একসময় জেলের ভেতরেই কনডেমড সেলে থাকা বন্দিদের সাথে দেখা করতে আসতে পারতো দর্শনার্থীরা। তবে এখন মাসে একদিন জেল গেটে তারা দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পান।”
একজন বন্দি একবারে সর্বোচ্চ ৫ জন দর্শনার্থীর সাথে দেখা করতে পারেন। কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণত কনডেমড সেলের প্রত্যেক বন্দির কাছ থেকে তার নিকটাত্মীয়দের তালিকা নেন, নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া কনডেমড সেলের বন্দির সাথে দেখা করতে অনুমতি দেয় না কারা কর্তৃপক্ষ।
শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, “সাধারণত মাসে একদিন বন্দিদের সাথে দর্শনার্থীদের দেখা করার অনুমতি দেয়া হলেও বিশেষ বিবেচনায় কখনো কখনো ১৫ দিনের মধ্যেও কনডেমড সেলের আসামির সাথে দর্শনার্থীদের দেখা করতে দেয়া হয়।”
উচ্চ আদালতে দণ্ড পরিবর্তিত হলে কী হয়?
মাঝেমধ্যে দেখা যায় কোনো একটি বিচারিক আদালতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হলেও পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পরিবর্তিত হয়েছে।
বাংলাদেশে এই ধরনের বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে যেখানে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি উচ্চ আদালতে আপিল করার পর তার সাজা কমেছে বা মওকুফ হয়েছে।
আর এই ধরনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচার পেতে সাধারণত দীর্ঘসময় লেগে থাকে বলে মন্তব্য করেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।
এসব ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের রায় উচ্চতর আদালত থেকে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কনডেমড সেলেই থাকতে হয় বন্দিকে।
শামসুল হায়দার বলেন, “যতদিন পর্যন্ত উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বাতিল না করছে, ততদিন পর্যন্ত এ বন্দিকে কনডেমড সেলেই থাকতে হয়। কারা বিধি অনুসরণ করে কনডেমড সেল থেকে গিয়েই আদালতের কার্যক্রমে যোগ দিতে হয় বন্দীকে।”
আর এরকম অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বন্দিকে বছরের পর বছর কনডেমড সেলে থাকতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্দিদের কনডেমড সেলে থাকার নজির আছে বলে জানান মি. সিদ্দিকী।