একজন তরুণ উদ্যোক্তার সাহসিকতার সাতকাহন

মনজুর আলম : বিখ্যাত না হয়ে জীবন কাটালেও সুন্দর জীবন কাটানো সম্ভব, কিন্তু জীবনের মত জীবন না কাটিয়ে বিখ্যাত হওয়া কখনও সুন্দর জীবন হতে পারে না। যে গল্প থেমে যায় সেই গল্প আনন্দ বেদনার সাক্ষী হয়ে থাকে কালের পর কাল । যে গল্পের সমাপ্তি নেই সেই গল্প উপন্যাস হয়ে আক্ষেপ তৈরী করে।জীবন গল্পটাও একদিন থেমে যায় । হাসি আনন্দ বেদনা , স্মৃতি বিস্মৃতি হয়ে থেকে যায় যুগের পর যুগ ।নাম তার ফয়সাল আলম পিতা - আলহাজ্ব নুরুল আলম, মাতা-শাহানা বেগম, স্ত্রী ফাহমিদা আক্তার এবং দুই ছেলে সন্তানের বাবা নিহান এবং নিহিত। ১২ ই ডিসেম্বর ১৯৮৪ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে ২০০৭ সালের ২২ এপ্রিল কৈশোরের বন্ধু ইফতেখার আবেদীন হেলালের সঙ্গে এবং শিহাব ভাইয়ের সহযোগিতায় ইতালির রাজধানী রোমে পা রাখেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তরুণ ফয়সাল আলম। শুরুটা ছিল কঠিন। রোমে পৌঁছে সন্ধ্যায় সূর্যের আলো দেখে বিভ্রান্ত হলেও, পরদিন পোরদেনোন শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানেই আঙ্গুর বাগানে ১০ ঘণ্টা পরিশ্রম করে দৈনিক মাত্র ৪০ ইউরো আয় থেকে শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়।
কঠোর পরিশ্রম, শারীরিক ক্লান্তি আর হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও থেমে থাকেননি ফয়সাল আলম। এক সময় চলে যান চেসেনা শহরে, এরপর কাজের সন্ধানে চলে যান তুরিনোর এক রেস্টুরেন্টে, সেখানে ডিশওয়াশারের কাজ করেন। এরপর বলোনিয়ায় ফিরে এসে শুরু করেন সন্ধ্যাকালীন ইতালিয়ান ভাষার চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্স।
এরই মাঝে বন্ধু জাবেদের সহায়তায় আবেদন করেন ক্যাটারিং কোম্পানি CAMST Group-এ, যেখানে কাজের সুযোগ পেয়ে প্রতিদিন ওভারটাইম করে রাত পর্যন্ত কাজের পাশাপাশি চালিয়ে যেতে থাকেন ডিপ্লোমা। ২০০৯ সালে তিনি বলোনিয়ার বাংলাদেশ কমিউনিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এক পর্যায়ে ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। আতিকুল ইসলাম মিঠু ভাইয়ের সঙ্গে একটি ক্লিনিং কোম্পানি ক্রয় করেন ১৫ হাজার ইউরো দিয়ে। পরে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে কোম্পানি বন্ধ করতে হয়। তবে উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি নিজ নামে কোম্পানি খোলেন—Microservice di Alam Faisal।
চাপের মুখে একসময় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৬৫ হাজার ইউরো। সেই সময় পরিবার তাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। ২০১৪ সালে ফাহমিদা আক্তারকে বিয়ে করেন। কিন্তু আর্থিক সংকটে পড়ায় স্ত্রীকে প্রথম দুই বছর কোনো খরচ পাঠাতে পারেননি।
সময় কেউ দেখতে পায় না !! কিন্তু সময় অনেক কিছু দেখিয়ে দেয় ,,সময় ও প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষের ভাবনাও বদলে যায়।
২০১৫ সালে স্ত্রীকে ইতালিতে নিয়ে আসার পর তার নামে Business Extension Academy নামে একটি নতুন কোম্পানি খোলেন। এরপর একের পর এক ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুরু হয়। একটি ইতালিয়ান ক্লিনিং কোম্পানি কিস্তিতে ক্রয় করেন, যা সফলতার মুখ দেখে।
২০১৮ সালে প্রথম সন্তানের বাবা হন। সন্তানের জন্মের পরপরই তিনি দেশে যান মা-কে নাতি দেখানোর জন্য। কিন্তু করোনা মহামারিতে আটকা পড়ে যান দেশে, এবং সেখানেই মা শাহানা বেগমের মৃত্যুবরণ করেন। ১১ মাস দেশে অবরুদ্ধ থাকার পর ২০২০ সালের নভেম্বরে ইতালিতে ফিরে আসেন। এই সময় কোম্পানির কাজ সুচারুভাবে চালিয়ে যান হুমায়ুন কবির ও মিয়া আশিক।
এরপর তিনি যুক্ত হন লজিস্টিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে। সফলভাবে একটি Industrial Construction Company গড়ে তোলেন এবং GSE, Amazon, FedEx, F-Engineering-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান।
২০২১ সালে MACMART GROUP LIMITED প্রতিষ্ঠা করেন এবং আন্তঃবন্দর Interporto di Bologna-তে কাজ শুরু করেন। ২০২২ সালে বিখ্যাত Ducati Motor Holding S.p.A-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান RC Motor Projects - Isotta-এর সঙ্গে শ্রমিক সরবরাহে চুক্তি হয়।
২০২৪ সালে নিউ ইয়র্ক চেম্বার অফ কমার্স আয়োজিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করেন এবং ২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ ব্যবসার গ্র্যান্ড ওপেনিং করেন ফয়সাল আলম।
বর্তমানে ফয়সাল আলমের মালিকানাধীন চারটি কোম্পানি সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো—কোম্পানিগুলোকে শতভাগ পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলা, দূষণমুক্ত কারখানা প্রতিষ্ঠা, পুনঃব্যবহারযোগ্য পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ দেয়া এবং তরুণদের জন্য দক্ষতা ভিত্তিক কর্মসংস্থান তৈরি করা।
যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে যোদ্ধারা কোনদিন পালায় না, সত্যিকারের যোদ্ধারা হারে না, প্রজারা জয়োধ্বনি তুলে রাজা রাজা কেউ বা আবার বলে মহারাজা দিন শেষে সত্যিকারের যোদ্ধারাই টিকে থাকে |
এই তরুণ উদ্যোক্তার সাহসিকতা, পরিশ্রম আর অবিচল মনোবল নিঃসন্দেহে প্রবাসীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম।সবার জন্য সুস্থ্য এবং সুন্দর জীবন যাপন কামনা রইলো । আল্লাহ হাফেজ।