ইউরোপের সবচেয়ে বড় জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট এতনা
বাংলা শব্দ আগ্নেয়গিরি এর ইংরেজি হচ্ছে Volcano এবং যা ইতালিয়ান ভাষায় Vulcano। ইতালিয়ান শব্দটির মূলে রয়েছে ল্যাটিন শব্দ Vulcanus, যার অর্থ জলন্ত পর্বত।আগ্নেয়গিরি ইতালিয়ান এবং ইংরেজী শব্দের উৎপত্তি রোমান পৌরাণিক কাহিনীর আগুনের দেবতার নাম Vulcan থেকে। আগ্নেয়গিরির কথা কম বেশি সবাই জানেন আর আগ্নেয়গিরির রহস্য সম্পর্কে মানুষের জানার আগ্রহের ও শেষ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ভয়ঙ্কর এই সব আগ্নয়গিরি জেগে ওঠার খবর প্রায়ই আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই। তবে আজ তবে আপনাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো ইউরোপের সবচেয়ে বড় জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি মাউন্ট এতনা থেকে। এতনা আগ্নেয়গিরির সাথে আমার পরিচয় যখন বাংলাদেশে ক্লাস ফাইভ এ পড়ি তখন একটি দৈনিক থেকে। তখন প্রকৃতির এই বিস্ময়কর ভৌগোলিক প্রক্রিয়ার বাস্তব উদহারণ এত কাছ থেকে দেখবো তা কখনো কল্পনাও করিনি। এই আগ্নেয়গিরির উচ্চতা বিশালতা আর তার প্রাকৃতিক সুন্দর্য খালি চোখে দেখে বিস্ময় না হবার উপায় নেই। ভৌগোলিকদের মতে এই দ্বীপের উৎপত্তি এতনা আগ্নেয়গিরি থেকে।
এটি প্রাচীনকালের একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ বছর এর উত্পত্তি ঘটেছিল আর খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ বছর আগে থেকে জীবন্ত ইতালির সব থেকে বড় দ্বীপ সিসিলির এই আগ্নেয়গিরি। এই আগ্নেয়গিরির ঠিক দক্ষিণে তিররেনীয় সাগরে স্ট্রম্বলি নামে আরেকটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এটি ভূমধ্যসাগরীয় আলোকস্তম্ভ নামে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিক শাস্ত্রে বলা হয়, এটি পবন দেবতার দ্বীপ। স্ট্রম্বেলি হলো ইউরোপের ভূখণ্ডের একমাত্র জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি যা সব সময়ই লাভা ছড়ায়। এবার ফিরে অ্যাতনা ভ্রমনে। আমার বসবাস ইতালির দক্ষিণের দ্বীপ সিসিলির রাজধানী পালেরমোতে। এখন থেকে অ্যাতনা প্রায় ৩০০ কিলোমিটারের পথ।সিসিলির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও বাণিজ্যিক শহর কাতানিয়াতে মাউন্ট এতনা অবস্থিত। পালেরমো থেকে এতনা আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় পিকনিক স্পট এ যেতে প্রায় চার ঘন্টার রাস্তা। সিসিলির বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত বাংলাদেশিদের ভ্রমণের জন্য এতনা বেশ জনপ্রিয়। প্রতি বছরই গ্রীষ্মকালে বিভিন্ন সংগঠন থেকে এতনা ভ্রমণের আয়োজন করা হয়ে থাকে । পালেরমো শহর থেকে বের হয়ে পালেরমো কাতানিয়া হাইওয়েতে উঠলাম রাস্তার দুদিকে সমতল আর উঁচুনিচু ভূমিতে বিস্তৃত ফসলি জমিতে কৃষকের ব্যস্ততা আর মাঝে মধ্যে বিশাল গরু আর ভেড়ার পাল পাহাড়ের ঢালে সবুজ ঘাসে চড়ে বেড়াচ্ছে ।ইউরোপের মাঠিতে এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায়না। মনের ভেতর বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল গ্রামগুলোর চিত্র ভেসে উঠলো, নষ্টালজিক না হয়ে উপায় ছিলোনা। গাড়ী ছুটে চলছে সকাল গড়িয়ে দুপুর প্রায় তিন ঘন্টা ড্রাইভ করার পর কাতানিয়া শহরের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার ডান পাশে একটু একটু করে বিশাল এই আগ্নেয়গিরির দৃশ্যমান হতে থাকলো। ইতালির তিনটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির মধ্যে এটি অন্যতম।
পৃথিবীর সুউচ্চ আগ্নেয়গিরির মধ্যে যা দীর্ঘতম। প্রায় ১১ হাজার ফুট উঁচু এ আগ্নেয়গিরি। মাউন্টের পুরো অঞ্চলটা প্রায় ৪৬০ স্কয়ার মাইল। এটি একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি হওয়ার কারণে এ আগ্নেয়গিরিতে লাভা দেখা যায়। সেই লাভা কেবল ক্ষুদ্র পরিসরেই হয় না। বরং এ আগ্নেয়গিরির কারণে শহর কাতানিয়া বেশ কবার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। শেষে ১৬ শতকে এ আগ্নেয়গিরি হতে বিপুল পরিমাণ লাভা নির্গত হয়েছিল। তবে এখনও থেমে নেই। অল্প-স্বল্প লাভা এখনও আগ্নেয়গিরির মুখ গলে বেরিয়ে আসে পাহারের পাদদেশে। এক্টিভআগ্নেয়গিরির হওয়ার দরুন এ এলাকার জমি খুব উর্বর হয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো মাউন্ট এটনাকে বিশ্ব হেরিটেজের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। আঁকাবাঁকা পথে বেয়ে এগোচ্ছি।ম্যাউন্টেনের নিচের দিকে জনবসতি বাজার দোকানপাট রয়েছে। আরো উপরের দিকে উঠলে মনে হবে কোনো গণ জঙ্গলের আঁকাবাঁকা পথে আপনি গুরে বেড়াচ্ছেন পাহাড়ের ডালে চারদিকে সবুজ গাছ-পালা ছড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে এই সবুজ আগ্নেয়গিরি কালো ছাইর মাঝে হারিয়ে যেতে থাকে।সবুজ থেকে এই কালোর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মনের ভিতর এক অন্নরকম অনুভূতির জন্ম দেয় তখন অবাক চোখে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। আমাদের প্রকৃতি কত বৈচিত্রময় মনে হয় যেন কালো রং দিয়ে রং করা হয়েছে পুরো এলাকাকে। এ যেন কালো আর সবুজের এক অবর্ণনীয় শংস মিশ্রণ। সমুদ্রপৃষ্ট হতে প্রায় ৬০০০ ফিট উপরে গাড়ি চলার পথ শেষ হয়।এরপর ক্যাবলকারে পাহারের চূড়ায় উঠতে হবে। যেখান থেকে আগ্নেয়গিরির লাভা নির্গমনের প্রধান মুখ দেখতে পাওয়ায় । এই আগ্নেয়গিরিতে আপনি বছরের যেকোনো সময়ই ভ্রমণ করতে যান না কেন সেখানে নামার সাথে সাথে দূরের সাগর, অবিরত নির্মল বাতাস কিংবা সাদা মেঘের ভেলা আপনাকে শীতল অবর্তনা জানাবেই । কখনো কখনো সাদা মেঘ আপনার শরীর স্পর্শ করে যাবে।
শীতের সময় এখানে বেশ বরফ জমে তখন দূর থেকে এই আগ্নেয়গিরি দেখলে মেনে হয় কালো পাহাড়ের মাথায় কেউ সাদা টুপি পরিয়ে দিয়েছে। এতনার পিকনিক স্পট বিশাল একটি এলাকা জুড়ে সাজানো হয়েছে। গাড়ি বাস পার্কিং এর জন্য বিশাল জায়গা, হেলিকপ্টার প্যাড। ছোট বড় অনেক গুলো স্যুভেনির এর দোকান ও পাশাপাশি কফি বার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। পুরো এলাকা ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে রেলগাড়ি আকৃতির একটি বাহন যেটির মাধ্যমে ১০ ইউরোর টিকেট দিয়ে ১ ঘন্টা এই পাহাড়ের বিশেষ বিষয়ে জায়গা দেখতে পাবেন এবং ছবি তুলতে পারবেন। তবে আগ্নেয়গিরির চূড়ার উঠার জন্য আপনাকে ক্যাবলকার নিতে হবে। জনপ্রতি ৫৪ ইউরো করে টিকেট সংগ্রহ করে ক্যাবলকারে ১০ মিনিটের পথ পারি দিতে হয় তার পর সেখান থেকে পাহাড়ের উঠার বিশেষ বাহনের মাধ্যমে আগ্নেয়গিরির প্রধান মুখ থেকে বেড় হওয়া ধুয়া কিংবা লাভা দেখতে পারবেন। প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্য এই আগ্নেয়গিরির অবশ্যই ভ্রমণ করার মত একটি জায়গা। এখানে সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও মাউন্ট অ্যাতনা ভ্রমণের জন্য গ্রীস্মকালই উপযুক্ত সময়।