পর্তুগালে কার্নেশন বিপ্লবের আগের জীবন এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র
মোঃ জহিরুল হক, পোর্তো-পর্তুগাল: 25 এপ্রিল প্রতিটি পর্তুগিজদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। ১৯৭৪ খুব বেশিদিন আগে নয়! মাত্র ৫০ বছর! তবে এটি পর্তুগালের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং সেই তারিখের আগের জীবন পর্তুগিজদের মনে দাগ কেটে আছে । পর্তুগালে বিপ্লবের আগের জীবন স্বৈরশাসন কতৃক কঠোর সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবন অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ছিল। মৌলিক ও নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল। মিডিয়া ব্যাপকভাবে সেন্সর করা হয়েছিল, মিডিয়া কার্যত অস্তিত্বহীন ছিল।
গোপনে পুলিশ সম্ভাব্য ভিন্নমতাবলম্বীদের পর্যবেক্ষণ করতো, ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে ছিল সবখানে। অনেক নাগরিক ভয়ে তাদের বাড়ির সীমানার মধ্যেও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে সাহস করতো না। একটি অনিবার্য বাস্তবতা ছিল বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা! যা সবার অপছন্দনীয় ছিল। নারীরা কর্মক্ষেত্রে অবহেলিত ছিল, নারীদের সমাজে সীমিত ভূমিকা ছিল এবং তারা সাধারণত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ সহ পারিবারিক জীবনেও সীমাবদ্ধ ছিল।
পর্তুগিজরা প্রতিরোধ করার জন্য ছোট ছোট উপায় খুঁজে পেয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল 'ফ্যাডো' মানে 'লোকসংগীত এবং গোপন সাহিত্য' যেটিতে প্রায়শই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জীবনের অবগুণ্ঠন সমালোচনা করে তরুণ সমাজ ও রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ কে জাগ্রত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। বন্দুকের নল থেকে বুলেট নয়, ফুল ! তারপর আসে সেই মহেন্দ্রক্ষন কার্নেশন বিপ্লব। কার্নেশন বিপ্লব ৪০ বছরেরও বেশি একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং ইউরোপের দীর্ঘতম টিকে থাকা কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটায়। এটি রেডিওতে সঙ্গীত দিয়ে শুরু হয়েছিল - প্রথমে, ২৪শে এপ্রিল রাত 10:55 মিনিটে, পাওলো ডি কারভালহোর 'ই ডিপোইস ডো অ্যাডাস' বাজানো হয়েছিল; তারপর ২৫ শে এপ্রিল 00:25 এ, রেডিও রেনাসেনসাতে জোসে আফনসোর 'গ্রান্ডোলা, ভিলা মোরেনা' বাজানো হয়েছিল। এটি অস্বাভাবিক ছিল!
কারণ কমিউনিস্ট আদর্শের সাথে সংযোগের কারণে এটি দেশে একটি নিষিদ্ধ গান ছিল এবং এটি ছিল মানুষের কাছে দ্বিতীয় লক্ষণ যে বিপ্লব শুরু হচ্ছে এবং বিপ্লবীদের দেশের কৌশলগত পয়েন্টগুলি দখল করা উচিত। সেলেস্টে কাইরো থেকে কার্নেশন বিপ্লবের নামকরণ করা হয়েছিল । সেই দিন সেলেস্টের একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করার কথা ছিল, কিন্তু বিপ্লবের কারণে, এটি খোলা হয়নি। দিনটি ছিল ২৫ এপ্রিল, রেস্তোরাঁটির প্রথম বার্ষিকী উদযাপনে উপলক্ষে মালিকরা তার সমস্ত গ্রাহকদের ফুল দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু সেই দিন, অভ্যুত্থানের কারণে সম্ভব হয়নি। সেলেস্টেকে কার্নেশন সহ বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু যখন সেলেস্ট রাস্তায় ট্যাঙ্কগুলি দেখেছিলেন এবং তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন কী হচ্ছে, তারা উত্তর দিল: 'এটি একটি বিপ্লব!'।
একজন সৈনিক একটি সিগারেট চেয়েছিল, কিন্তু তার কাছে কিছুই ছিল না এবং সব জায়গা বন্ধ ছিল। তার কাছে একমাত্র ফুল ছিল - তাই সে সৈন্যদের বন্দুকের মুখের মধ্যে ফুল রেখেছিল (শান্তির প্রতীকী হিসাবে) যা পরে কার্নেশন সেলেস্ট নামে পরিচিতি লাভ করে। স্বৈরাচারের অবসান উদযাপনের জন্য জনগণ রাস্তায় নেমেছিল, এবং অন্যরা তা অনুসরণ করেছিল, বন্দুক এবং সৈন্যদের ইউনিফর্মে কার্নেশন স্থাপন করা হয়েছিল এবং ফুলের সাথে বন্দুকের ছবি শান্তির প্রতীকী প্রতীক হয়ে উঠেছিল সেদিন।
25 শে এপ্রিল এখন পর্তুগাল জুড়ে প্রতি বছর পালিত হয় এবং সাধারণত 'দিয়া ডি লিবারডে' বা স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পরিচিত। কার্নেশন ফুল তখন থেকে পর্তুগিজ জনগণের জন্য শান্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছে । যুদ্ধ অথবা বিপ্লব, শান্তি বা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, এ সবের সঙ্গে বার বার জড়িয়ে থাকে ফুলের নাম অথবা বিপ্লবের নাম 'কার্নেশন বিপ্লব'। ১৯৭৪ সালে ২৫ এপ্রিল পর্তুগালে প্রতিষ্ঠা হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র। আর এই এক দলীয় শাসন ব্যবস্তার থেকে মুক্ত হয়ে চালু হওয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রকে পর্তুগালের জনগন পালন করে থাকে তাদের 'স্বাধীনতা ও বিপ্লবী দিবস' হিসেবে।